মার্চ ২৮, ২০২৪ ৪:২৫ অপরাহ্ণ || ইউএসবাংলানিউজ২৪.কম

দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থান জোরালো করতে চায় তুরস্ক

১ min read

তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসোগলু গত দুই মাসের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় দুবার সফর করে গিয়েছেন। এসব সফর চলাকালে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে তার বক্তব্যে পরিষ্কার হয়ে এসেছে, নিজস্ব ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের অবস্থান জোরালো করে তোলা প্রয়োজন বলে মনে করছে আঙ্কারা।

এর আগে ২০১৯ সালের আগস্টে এশিয়াকে কেন্দ্র করে ‘এশিয়া আ নিউ’ উদ্যোগ হাতে নেয় তুরস্ক। মেভলুত চাভুসোগলু প্রণীত এ পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য হলো প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি, বিনিয়োগ ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে তুরস্কের যোগাযোগ বৃদ্ধি করা। এ পদক্ষেপ সফল হলে গোটা মহাদেশেই তুরস্ক আরো প্রভাবশালী হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন চাভুসোগলু ও তার সহযোগীরা।

তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক কার্যক্রম বলছে, ‘এশিয়া আ নিউ’ কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার ওপরই তার মনোযোগ এখন সবচেয়ে বেশি। তুরস্কের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদেও এ কথারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে এখন। সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, তুরস্কের এশিয়াবিষয়ক পররাষ্ট্রনীতিতে এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো; বিশেষ করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান গুরুত্ব পাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক অতীতে খারাপ না হলেও সাম্প্রতিক সময়ে বেশ মনকষাকষি চলছে আঙ্কারা ও নয়াদিল্লির।

দক্ষিণ এশিয়ায় তুরস্কের আগ্রহী হয়ে ওঠার পেছনে এখন পর্যন্ত বেশকিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন পর্যবেক্ষক ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, এর পেছনে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ অনেক কারণই প্রভাব ফেলেছে। প্রথমত, সমসাময়িক বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক ভরকেন্দ্র এখন অনেকটাই প্রাচ্যের দেশগুলোয় সরে এসেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তনের কারণে চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশগুলো এখন বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে ক্রমেই শক্তিসঞ্চার করে চলেছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রভাবক হিসেবে এসব দেশের ক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি তুরস্ককে এ পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণে বাধ্য করছে। অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব এখন ক্রমেই পড়তির দিকে। উপরন্তু এসব দেশের সঙ্গে গত কয়েক বছরে আঙ্কারার দূরত্বও অনেক বেড়েছে। বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্যে এ পরিবর্তনের কারণেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনতে উদ্যোগী হয়ে উঠেছেন মেভলুত চাভুসোগলু। এদিক থেকে তিনি বর্তমানে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে একদিকে যেমন সুসম্পর্ক তৈরিতে প্রয়াসী হয়েছেন, তেমনি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে চীন ও ভারতের মধ্যকার আঞ্চলিক নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও বৈরী পরিস্থিতিকেও কাজে লাগাতে চাইছেন।

এশিয়া আ নিউ পরিকল্পনা বলছে, এ মহাদেশের প্রধান কয়েকটি দেশে সফট পাওয়ার অ্যাসেটকে (সংস্কৃতি, মতাদর্শ, পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি) কাজে লাগানোর পাশাপাশি বিরোধ নিষ্পত্তিতে ভূমিকা রাখা এবং অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা শিল্পে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এশীয় ভূরাজনীতিতে নিজের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করবে তুরস্ক। এক্ষেত্রে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চাবিকাঠি হিসেবে দেখা হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানকে।

তুর্কি রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিনেম চিঙ্গিজও সম্প্রতি আরব নিউজে প্রকাশিত এক নিবন্ধে লেখেন, মেভলুত চাভুসোগলুর পররাষ্ট্রনীতিতে এখন বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে দেশগুলোর অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার গতি ও কৌশলগত গুরুত্বের কারণে।

গেলো মাসেই ঢাকায় নবনির্মিত তুর্কি দূতাবাস উদ্বোধন করতে আসেন মেভলুত চাভুসোগলু। সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। তুর্কি দূতাবাসও উদ্বোধন করেন দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একসঙ্গেই। ওই সময় তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো জোরদার করতে আগ্রহী তুরস্ক। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক বাণিজ্য ও দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক কার্যক্রম বৃদ্ধিতেও আঙ্কারা আগ্রহী। এছাড়া ঘোষণা দিয়েছেন কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে থাকারও।

ওই সময়ে চাভুসোগলু বলেন, প্রাণবন্ত অর্থনীতি ও তরুণ জনসংখ্যার আধিক্যের সুবাদে এশিয়া আ নিউ উদ্যোগে তুরস্কের অন্যতম প্রধান অংশীদার হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ।

সম্প্রতি কাশ্মীর ইস্যুতে আঙ্কারার পাকিস্তানের পক্ষ গ্রহণের ফলে তুরস্ক ও ভারতের সম্পর্ক কিছুটা শীতল হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে সিরিয়ায় তুর্কি ভূমিকা নিয়ে নয়াদিল্লির নিন্দা জ্ঞাপনে এ সম্পর্ক হয়ে উঠেছে শীতল থেকে শীতলতর। যদিও এখনো এশিয়ায় তুরস্কের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার ভারত। তবে নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্কের এ শীতলতার কারণে এ মুহূর্তে তুরস্ক দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে আরো আগ্রহী হয়ে উঠেছে বলে দাবি করছে তুর্কি গণমাধ্যম।

বাংলাদেশ সফরের ঠিক এক মাসের মাথায় সপ্তাহ দুই আগে পাকিস্তান সফরে যান মেভলুত চাভুসোগলু। গত আড়াই বছরের মধ্যে এটি ছিল পাকিস্তানে তার তৃতীয় সফর। সেখানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশির সঙ্গে বৈঠক হয় তার। এছাড়া পাকিস্তান, তুরস্ক ও আজারবাইজানের মধ্যে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের কৌশলগত সহযোগিতা কাউন্সিলের বৈঠকেও অংশ নেন তিনি। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন খাতে পাকিস্তানের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক এক ভিন্ন রকম উচ্চতায় পৌঁছেছে। রাজনৈতিক, প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিকসহ সম্ভাব্য সব খাতেই দেশ দুটির যোগাযোগ দিনে দিনে আরো জোরালো হয়ে উঠছে। অন্যদিকে এ সম্পর্ককে আরো এগিয়ে নেয়ার সফট পাওয়ার অ্যাসেট হিসেবে কাজ করছে সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রম।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে তুরস্কের আগ্রহের আরো একটি দিক রয়েছে। সেটি হলো দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর আধিক্য। মুসলিম বিশ্বে প্রভাব বৃদ্ধি নিয়ে বর্তমানে সৌদি আরবের সঙ্গে একধরনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে তুরস্ক। রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০২ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এ প্রতিযোগিতার শুরু।

বিশ্বব্যাপী মোট মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশেরই বসবাস দক্ষিণ এশিয়ায়। এ কারণে মুসলিম বিশ্বে আঙ্কারার প্রভাব ও ভাবমূর্তি বাড়ানোর জন্যও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর দিকেই বাড়তি মনোযোগ দিচ্ছেন এরদোগানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে, তেমনি গুরুত্ব পাচ্ছে সংখ্যালঘু কিন্তু বিপুলসংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশ ভারতও।

এ বিষয়ে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের (আইএসএএস) প্রকাশিত এক পলিসি পেপারে ভারতীয় অধ্যাপক বিনয় কাউরা লেখেন, সৌদি আরবের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের স্থান পাওয়ার তাগিদ থেকে এখন ভারতীয় মুসলমানদের কাছেও পৌঁছতে পেরেছে আঙ্কারা ।

Comments

comments

More Stories

১ min read
১ min read

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!