মার্চ ২৯, ২০২৪ ৫:১৫ পূর্বাহ্ণ || ইউএসবাংলানিউজ২৪.কম

অভিশংসনই কি অনিবার্য?

১ min read

ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকেই একের পর এক নির্বাহী আদেশ জারি করে চলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আদেশের কোনোটিই আমেরিকান জনগোষ্ঠীর সাধুবাদ পায়নি, উল্টো দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী বলে কথার বিষ হজম করতে হয়েছে তাকে।

সবশেষ তিনি ৭টি মুসলিমপ্রধান দেশের অভিবাসী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যে আদেশ জারি করেছেন, তাতে সমালোচনায় জর্জরিত হতে হচ্ছে আমেরিকার নয়া কমান্ডার ইন চিফকে। সমালোচনা এতোই শুরু হয়েছে যে, তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ তো চলছেই, এমনকি অভিশংসনের প্রচারণাও শুরু হয়ে গেছে।

আসলে অভিশংসনই কি ট্রাম্পের লাগাম টানতে অনিবার্য হয়ে উঠেছে? এ নিয়ে চলছে চুলচেরা আলোচনা- বিশ্লেষণ। মার্কিন একটি জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে লিখেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক রবার্ট কাটনার। তার ভবিষ্যদ্বাণীটি উপস্থাপন করা হচ্ছে বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য।

ট্রাম্প আসলে সরকার পরিচালনা করছেন বেখেয়ালে, ব্যক্তিগত স্বার্থ-লাভে। একের পর এক এমনভাবে অধ্যাদেশ জারি করছেন যেন তিনি নির্বাচিত স্বৈরশাসক। কোনো কিছুই (সমালোচনা) কাজ করছে না। বাসের চাকা খুলে যাচ্ছে। এক সপ্তাহ পর তো তাই দেখা যাচ্ছে!

এখন কেবল বড় হচ্ছে অভিশংসনের জায়গা। কারণ এটাই তাকে ছুঁড়ে ফেলার একমাত্র পথ। এরইমধ্যে রিপাবলিকান সঙ্গীরা তাকে একলা রেখে লেজ গোটাচ্ছে। কারণ সবাই বুঝছে যে, কোনো কিছু করার আগে সেটা আইনসম্মত কিনা তা খতিয়ে দেখার মানসিক সক্ষমতাও নেই লোকটার।

অভিশংসনের জায়গা আরও বড় হচ্ছে, কারণ এটা ভয়ানকভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে ট্রাম্প এই অফিসের (হোয়াইট হাউস) অযোগ্য। তার আশপাশে যে উজির-নাজিররা আছে, এমনকি যে একেবারেই তার প্রতি অন্ধ অনুগত, তারা নিজেদের সময়ের অর্ধেকেরও বেশি ব্যয় করছে লোকটার লাগাম টানতে, কিন্তু কাজ হচ্ছে না।

কেবল তাকে নিয়েই উজির-নাজিরদের ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে না, তাদের সামলাতে হচ্ছে রিপাবলিকান রথি-মহারথিদের, লোকটার ব্যবসায়িক অংশীদারদের এবং বিদেশি নেতাদের। তাহলে ট্রাম্প করেনটা কী? বেচারা রেয়ান্স প্রিবাস (হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ) শেষতক ‘ক্ষমতার চূড়ায় আরোহনের’র মজা পাচ্ছেন। এটা আসলেই কি মজা?

যখন আপনি একজন প্রার্থী (প্রেসিডেন্ট) তখন একরকমের বাস্তবতায় থাকবেন এবং তখন যা বলবেন তা কেবলই বুলি। তখন আপনি লোকজনকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বোকা বানিয়ে নির্বাচিতও হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু যখন আপনি ঠিক এইভাবেই সরকার চালাতে চাইবেন, তখন আপনাকে বাস্তবতার বাস্তবতায় পড়তে হবে- আর বাস্তবতা সবসময়ই পেছনে ঠেলে।

ট্রাম্পেরও হচ্ছে সেই দশা। একের পর এক কেবল বেখেয়ালি অধ্যাদেশ জারি করছেন। এক্ষেত্রে তিনি যেমন আইনি, নীতিনির্ধারক বা রাজনৈতিক কর্মীদের দিয়ে নিরীক্ষার প্রয়োজনবোধ করছেন না, তেমনি করছেন না আন্তরিক কোনো পরিকল্পনাও। এসব ক্ষেত্রে প্রায় সবাইকেই তিনি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দেখিয়ে বাস্তবতার জালে ফেলে পিছু হটতে বাধ্য করছেন।

শুরুর দিকে অন্য স্বৈরশাসনের মতো ট্রাম্প অবশ্য বেশি বেকায়দায় পড়ছিলেন না সাংবিধানিক বিধি এবং রাজনৈতিক মারপ্যাঁচের জটিলতায়। সে কারণে তার বেপরোয়া আচরণ আরও লাগামহীন হতে থাকলো।

কিন্তু উন্মাদের মতো কিছু নির্দিষ্ট দেশের শরণার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা (সব দেশ নয়, যেমন সৌদি আরব ও মিশরের মতো সন্ত্রাসী-প্রেরক দেশগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি, সেখানে ট্রাম্পের ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত বলে) দিয়ে ট্রাম্প বুঝতে পারলেন আমেরিকার রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় আদালতও আছে।

তিনি মস্তিষ্কের বিকৃতির যতো প্রকাশ ঘটাবেন, রক্ষণশীল বিচারকরাও তার প্রতি দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে থাকবেন, যদিও এ ধরনের দুর্বলতা কমই দেখা গেছে। কেউ কি বাজি ধরতে পারবে (যদি রক্ষণশীল বিচারকদের অনুকম্পা পানও ট্রাম্প) যে সুপ্রিম কোর্ট (এসব কর্মকাণ্ডের পরও) ট্রাম্পের মনোরঞ্জনে অবতীর্ণ হবেন?

গত সপ্তাহে রিপাবলিকানরা একে অপরের সঙ্গে ভ্লাদিমির পুতিনের বিষয়ে আলাপ করছিল। ট্রাম্পকে জেতানো নির্বাচনে পুতিনের বিরুদ্ধে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছিলেন কেউ কেউ। আলোচনা যেন এটাই ছিল।

এরপর রোগী বা রিপাবলিকানদের পুননির্বাচনের প্রত্যাশা দমিয়ে না দিয়ে কিভাবে ‘ওবামাকেয়ার’ (প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে চালু স্বাস্থ্যবিমা) বাতিল করা যায় তার পথ খুঁজছিলেন তারা। সে ব্যাপারগুলোও জটিল হয়ে উঠছিল।

এখন সব ছাপিয়ে ট্রাম্পের বেপরোয়া আচরণই আলোচনায়। সে হোক ডেমোক্র্যাট শিবির, হোক রিপাবলিকানদের ঘর। ক্যালিফোর্নিয়ার রিপাবলিকান রাজনীতিক টম ম্যাকক্লিনটকই যেন সবার কথা বলে দিলেন সতর্কতার সঙ্গে: “যে মার্কেট আমরা তৈরি করেছি (ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন) সেটাকে ছাড়া বাঁচতে পারার প্রস্তুতি রাখাটা আমাদের জন্য ভালো হবে।”

“এটাকে ট্রাম্পকেয়ার বলা যেতে পারে। রিপাবলিকানরা এই লক, স্টক ও ব্যারেলের দেখাশোনা করবে এবং আমরা দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে নির্বাচনে তার ফয়সালার মুখোমুখি হবো।”

ট্রাম্পের সিনিয়র কর্মকর্তাদেরই উচিত ছিল মেক্সিকোর সঙ্গে তার এই হাস্যকর ক্রুসেড ঘোষণা (দেওয়াল নির্মাণের ঘোষণা এবং পণ্য প্রবেশে অতিমাত্রায় করারোপ) থেকে তাকে বিরত রাখা। উল্টো ট্রাম্প এ ধরনের খেয়ালিপনা করে মেক্সিকান প্রেসিডেন্টকে যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিলে বাধ্য করেছেন এবং পরের দিন অহেতুক একঘণ্টা ফোনালাপ করেছেন।

ট্রাম্প প্রস্তাব করেছেন তিনি আসামি নির্যাতন করে তথ্য আদায় সংক্রান্ত আইনটি আবার প্রতিষ্ঠিত করতে চান। খোদ রিপাবলিকানরাই তাকে দমিয়েছেন এই বলে যে এটা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে এবং এটা যদি আবারও তিনি কংগ্রেসে পাসের জন্য পাঠান, তবে খোদ রিপাবলিকানরাই এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেবে। ট্রাম্পের প্রতিরক্ষামন্ত্রীও দেন একই মতামত। সবাই টুটি চেপে ধরায় ট্রাম্প অবশেষে ওই আইন নিয়ে বলতে বাধ্য হন, “আমি আমার উপদেষ্টাদের সঙ্গে একমত।”

এতো কিছুর পরও বেপরোয়া ট্রাম্প। তাই প্রথম সপ্তাহান্তেই তার লাগাম টানতে এবার এগিয়ে এলেন কেন্দ্রীয় আদালত।

দু’সপ্তাহ আগেই আমি ট্রাম্পের ক্ষমতাগ্রহণের সময় তার অঙ্গভঙ্গি ও বক্তব্য দেখে বলেছিলাম, এবার বুঝি নাগরিক অভিশংসন পরিষদ গঠন করতে হবে, তাকে অভিশংসনের জন্য। সেজন্য উদ্বুদ্ধও করেছিলাম নাগরিকদের একটি প্রচারণা গড়ে তুলতে।

দু’সপ্তাহ পর ঠিকই ‘ফ্রি স্পিচ ফর পিপল’ সংগঠন ট্রাম্পকে অভিশংসনে প্রচারণা শুরু করেছে। এরমধ্যে সংগঠনটির এক পিটিশনে প্রায় ৪ লাখ মানুষ স্বাক্ষর করেছে।

সিটিজেন্স ফর রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড ইথিকস ইন ওয়াশিংটন নামে একটি দ্বিদলীয় সংগঠন ট্রাম্পের কার্যক্রম তদন্তে কাজ করছে। সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ পণ্ডিতেরা খুঁজে দেখছেন যে ট্রাম্প এমোলুমেন্টস ক্লজ (একটি আইন, যার ফলে প্রেসিডেন্ট অন্য দেশের সরকারের কাছ থেকে রাজনৈতিক-কূটনৈতিক-ব্যবসায়িক বা অন্যান্য সুবিধা নিতে পারেন না) ভেঙে কী কী করেছেন।

মাঠে অভিশংসনের জায়গা এখন আরও বড় হচ্ছে। কিভাবে? এরমধ্যে তিনি ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের স্বার্থকে দেশের স্বার্থের আগে বিবেচনা করেছেন বলেও প্রতীয়মান হয়েছে। ভোটে কারচুপিতে অভিযুক্ত ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তার অদ্ভুত ও সুবিধাবাদী বন্ধুত্বও আমেরিকানদের ভাবনায় ডুবিয়েছে।

সেজন্য ক্ষমতা নেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ট্রাম্প যেমন সংবিধানকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন, তেমনি দূরে সরে যাচ্ছেন তার দলীয় বন্ধুরাও।ট্রাম্পের গা ছমছমে আচরণ সত্ত্বেও রিপাবলিকানরা প্রথমে ভেবেছিল তারা তাকে নিজেদের মতো ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু পুতিনের সঙ্গে সখ্য থেকে শুরু করে মেক্সিকোর সঙ্গে সাধারণ বাণিজ্য যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেওয়া, সবকিছুই এখন রিপাবলিকানদের কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছে।

এই হিসাব-নিকাশ আর ভাবনার সাগর থেকে আমেরিকানদের উদ্ধারে অভিশংসনের প্রসঙ্গটিই সামনে আসছে। এটি অবশ্যই রাজনৈতিক ও আইনি প্রক্রিয়া। অভিশংসন আইনটি যারা প্রতিষ্ঠা করেছেন তারা এসব কিছু মাথায় রেখেই করেছেন।

রিপাবলিকানদের জন্য সামনে নিছকই সেই বিপদ। ট্রাম্প শিগগির অভিশংসনের শিকার হবেন। এখন কেবল প্রশ্নটা হলো, সে পর্যন্ত আমেরিকাকে না জানি আর কতোটা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়।

Comments

comments

More Stories

১ min read
১ min read
error: Content is protected !!