মার্চ ২৮, ২০২৪ ৬:২১ অপরাহ্ণ || ইউএসবাংলানিউজ২৪.কম

আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে

১ min read

১০ জানুয়ারি ১৯৭২, রেসকোর্স

আমি প্রথমে স্মরণ করি আমার বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সেপাই, পুলিশ, জনগণকে, হিন্দু-মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করে এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমি আপনাদের কাছে দু-একটি কথা বলতে চাই। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমার বাংলা স্বাধীন থাকবে।

আমি আজ বক্তৃতা করতে পারব না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছে, আমি কারাগারে বন্দি ছিলাম, ফাঁসিকাষ্ঠে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙ্গালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। আমার বাংলার মানুষ স্বাধীন হবেই। আমি আমার সেই যে ভায়েরা আত্মাহুতি দিয়েছে, শহীদ হয়েছে, তাদের আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

আজ শতকরা, আমার মনে হয়েছে প্রায় ৩০ লাখ লোককে মেরে ফেলে দেয়া হয়েছে বাংলায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও এবং প্রথম মহাযুদ্ধেও এত লোক, এত সাধারণ নাগরিক মৃত্যুবরণ করে নাই, শহীদ হয় নাই। যা আমার এই সাত কোটির বাংলাদেশে হয়েছে। আমি জানতাম না, আপনাদের কাছে আমি ফিরে আসব। তাই আমি খালি একটা কথা বলেছিলাম। তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলে দাও, আমার আপত্তি নাই। মৃত্যুর পরে আমার লাশটা আমার বাঙ্গালির কাছে দিয়ে দিয়ো। এই একটা অনুরোধ তোমাদের কাছে রাখলাম।

আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে। আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের জনসাধারণকে। আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের সামরিক বাহিনীকে। আমি মোবারকবাদ জানাই রাশিয়ার জনসাধারণকে। আমি মোবারকবাদ জানাই ব্রিটিশ, জার্মানি, ফ্রান্স সব জায়গায় যে গভর্নমেন্ট-জনসাধারণ আছে, তাদের আমি মোবারকবাদ জানাই, যারা আমাকে সমর্থন করেছে। আমি মোবারকবাদ জানাই আমেরিকার জনসাধারণকে। আমি মোবারকবাদ জানাই বিশ্ব দুনিয়ার মজলুম জনসাধারণকে, যারা আমার এই মুক্ত সংগ্রামকে সাহায্য করেছে। আমার বলতে হয় এক কোটি লোক এই বাংলাদেশের থেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতবর্ষে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতের জনসাধারণ মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তাদের খাবার দিয়েছে। তাদেরকে মোবারকবাদ না দিয়ে পারি না। যারা অন্যরা সাহায্য করেছে, তাদের আমার মোবারকবাদ দিতে হয়। তবে মনে রাখা উচিত বাংলাদেশ স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে। বাংলাদেশকে কেউ দাবাতে পারবে না। বাংলার মধ্যে ষড়যন্ত্র করে লাভ নাই। আমি বলেছিলাম যাবার আগে—ও বাঙ্গালি, এবার তোমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবার তোমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, তোমরা তা করেছ।

আমি বলেছিলাম ঘরে ঘরে দুর্গ তৈয়ার করো। তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ তৈয়ার করে সংগ্রাম করেছ। আমি আমার সহকর্মীদের মোবারকবাদ জানাই। আমার বহু ভাই, আমার বহু কর্মী, আমার বহু মা-বোন, আমার বহু ভাই আইজ দুনিয়ায় নাই। তাদের আমি দেখব না। আমি আইজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়া অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই। আমার সোনার বাংলা তোমায় আমি বড় ভালোবাসি। বোধ হয় তার জন্য আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছে।

আমি আশা করি, দুনিয়ায় সব রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন যে আমার রাস্তা নাই, আমার ঘাট নাই, আমার জনগণের খাবার নাই, আমার মানুষ গৃহহারা, সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারি, তোমরা আমার মানুষকে সাহায্য করো। মানবতার খাতিরে তোমাদের কাছে আমি সাহায্য চাই। দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। আমার বাংলাদেশকে তোমরা রিকগনাইজ করো, জাতিসংঘে স্থান দাও। দিতে হবে উপায় নাই। দিতে হবে। আমি, আমরা হার মানব না, আমরা হার মানতে জানি না। কবিগুরু—কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সাত কোটি বাঙ্গালিরে হে বঙ্গজননী, রেখেছো বাঙ্গালি করে মানুষ করোনি। কবিগুরুর কথা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে। আমার বাঙ্গালি আইজ মানুষ। আমার বাঙ্গালি দেখিয়ে দিয়েছে দুনিয়ার ইতিহাসে, দুনিয়ার ইতিহাসে স্বাধীনতার সংগ্রামে এত লোক আত্মাহুতি, এত লোক জান দেয় নাই।

তাই আমি বলি, আমায় দাবায় রাখতে পারবা না। আইজ থেকে আমার অনুরোধ, আইজ থেকে আমার আদেশ, আইজ থেকে আমার হুকুম, ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়; আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই। এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণী আছে, তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়। মুক্তিবাহিনী (জনতার চিত্কার), মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ, কর্মিবাহিনী তোমাদের মোবারকবাদ জানাই। তোমরা গেরিলা হয়েছ, তোমরা রক্ত দিয়েছ, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় নাই।

একটা কথা, আইজ থেকে, আইজ থেকে বাংলায় যেন আর চুরি-ডাকাতি না হয়। বাংলায় যেন আর লুটতরাজ না হয়। বাংলায় যে লোক যারা আছে, অন্য দেশের লোক, পশ্চিম পাকিস্তানের লোক, বাংলায় কথা বলে না, আইজও বলছি তোমরা বাঙ্গালি হয়ে যাও। আর আমি আমার ভাইদের বলছি, তাদের উপরে হাত তোলো না। আমরা মানুষ, মানুষ ভালোবাসি। তবে যারা দালালি করেছে, যারা আমার লোকদের ঘরে ঢুকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার হবে এবং শাস্তি হবে (জনগণের উল্লাস, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান)। সরকারের কাছে, বাংলা স্বাধীন সরকারের হাতে ছেড়ে দেন, একজনকেও ক্ষমা করা হবে না। তবে আমি চাই স্বাধীন দেশে স্বাধীন নাগরিকের মতো স্বাধীন আদালতে বিচার হয়ে এদের শাস্তি হবে। আপনারা, আমি দেখায়া দিবার চাই দুনিয়ার কাছে যে শান্তিপূর্ণ বাঙ্গালি রক্ত দিতে জানে, শান্তিপূর্ণ বাঙ্গালি শান্তি বজায় রাখতেও জানে।

আমারে আপনারা পেয়েছেন, আমি আসছি। জানতাম না, আমার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম, বলেছিলাম, আমি বাঙ্গালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু আইসে থাকে যদি আমি হাসতে হাসতে যাব, আমার বাঙ্গালি জাতকে অপমান করা যাব না, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব না। (জনগণের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি) এবং যাবার সময় বলে যাব জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙ্গালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।

ভাইয়েরা আমার,

যথেষ্ট কাজ পড়ে রয়েছে। আপনারা জানেন আমি সমস্ত জনসাধারণকে চাই, যেখানে রাস্তা ভেঙে গেছে, নিজেরাই রাস্তা করতে শুরু করে দাও। আমি চাই জমিতে যারা ধান বোনাও। সব কর্মচারীদের বলে দিবার চাই, একজনও ঘুষ খাবেন না। মনে রাখবেন তখন সুযোগ ছিল না। আমি দোষ ক্ষমা করব না। ভাইরা আমার, যাওয়ার সময় যখন আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, তাজউদ্দীন, নজরুল এরা আমার থেকে যায়। আমি বলেছিলাম সাত কোটি বাঙ্গালির সাথে আমাকে মরতে দে তোরা। আমি আশীর্বাদ করছি। তাজউদ্দীন ওরা কানছিল, তোরা চলে যা, সংগ্রাম করিস, আমার আত্মা রইল, আমি এই বাড়িতে মরতে চাই, এই হবে বাংলার জাগা (জায়গা), এইখানে হয় আমি মরতে চাই। ওদের কাছে মাথা নত করে আমরা পারব না।

(জনগণের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি)

ভাইয়েরা আমার,

ডাক্তার কামালকে নিয়ে তিন মাস পর্যন্ত সেখানে ইন্টারোগেশন করেছে এই মজিবের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়ার। কয়েকজন বাঙ্গালি আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছে। তাদের আমরা জানি এবং চিনি। তাদের বিচার হবে। আপনারা আইজ, আমি বক্তৃতা করতে পারছি না। আপনারা বুঝতে পারেন। নমো নমো নমো, সুন্দরী মম জননী জন্মভূমি; গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ-সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।

আমার জীবন, আইজ যখন আমি ঢাকায় নামছি, তখন আমি চোখের পানি রাখতে পারি নাই। আমি জানতাম না যে এ মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, যে জাতকে আমি এত ভালোবাসি, যে বাঙ্গালি বাংলাদেশকে আমি এত ভালোবাসি, সেই বাংলায় আমি যেতে পারব কিনা। আইজ আমি বাংলাদেশে ফিরে এসেছি, আমার ভাইদের কাছে, আমার মা’দের কাছে, আমার বোনদের কাছে, বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলার মানুষ আজ আমার স্বাধীন।

আমি পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের বলি, তোমরা সুখে থাকো, তোমাদের বিরুদ্ধে আমাদের ঘৃণা নাই। তোমাদের আমরা শ্রদ্ধা করতে চেষ্টা করব। তোমার সামরিক বাহিনীর লোকেরা যা করেছে, আমার মা-বোনের ওপর রেপ করেছে। আমার ৩০ লক্ষ লোককে মেরে ফেলে দিয়েছে। যাও সুখে থাকো। তোমরা সুখে থাকো। তোমাদের সঙ্গে আর না। শেষ হয়ে গেছে। তোমরা স্বাধীন থাকো। আমিও স্বাধীন থাকি। তোমাদের সঙ্গে আমার স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বন্ধু হতে পারে; তাছাড়া বন্ধু হতে পারে না।

তবে যারা অন্যায়ভাবে অন্যায় করেছে তাদের সম্পর্কে যথেষ্ট ব্যবস্থা করা হবে। আপনাদের কাছে আমি ক্ষমা চাই। আর একদিন আমি বক্তৃতা করব, কিছুদিন পরে একটু সুস্থ হয়ে লই। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, আমি সেই মুজিবর রহমান এখন আর নাই। আমার বাংলার দিকে চাইলেই দেখেন সমান হয়ে গেছে জাগা, গ্রাম গ্রাম পোড়ায় দিয়েছে। এমন কোনো ফ্যামিলি নাই, যার মধ্যে আমার লোককে হত্যা করা হয় নাই। কত বড় কাপুরুষ যে নিরপরাধ নাগরিকদের এভাবে হত্যা করে সামরিক বাহিনীর লোকেরা। আর তারা বলে কি যে আমরা পাকিস্তানের মুসলমান সামরিক বাহিনী। ঘৃণা করা উচিত, জানা উচিত দুনিয়ার মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার পরে এই বাংলাদেশই দ্বিতীয় স্থান মুসলিম কান্ট্রি। মুসলমান সংখ্যায় বেশি; দ্বিতীয় স্থান। আর ইন্ডিয়া তৃতীয় স্থান, আর পশ্চিম পাকিস্তান চতুর্থ স্থান। আমরা মুসলমান, মুসলমান মা-বোনদের রেপ করে (পাকিস্তানিদের কথাকে ব্যঙ্গ করে বলছেন)। আমরা মুসলমান!

আমার রাষ্ট্রে এই বাংলাদেশে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা। এই বাংলাদেশে হবে গণতন্ত্র। এই বাংলাদেশে হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। যারা জানতে চান, আমি বলে দিবার চাই, আসার সময় দিল্লিতে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও যে সমা (সময়) আলোচনা হয়েছে। আমি আপনাদের বলতে পারি যে আমি জানি তাকে, তাকে আমি শ্রদ্ধা করি। সে পণ্ডিত নেহরুর কন্যা, সে মতিলাল নেহরুর ছেলের মেয়ে। তারা রাজনীতি করেছে, ত্যাগ করেছে। তারা আজকে সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছে। যেদিন আমি বলব, যেদিন আমি বলব, সেইদিন ভারতের সৈন্য বাংলার মাটি ছেড়ে চলে যাবে (জনগণের ‘জয় বাংলা’ উল্লাস) এবং তিনি আস্তে আস্তে কিছু কিছু সরায়ে নিচ্ছেন। তবে যে সাহায্য করেছেন, আমি আমার সাত কোটি দুঃখী বাঙ্গালির পক্ষের থেকে ইন্দিরা গান্ধীকে, তার সরকারকে, ভারতের জনসাধারণকে মোবারকবাদ জানাই। অন্তরের অন্তস্তল থেকে তাকে ধন্যবাদ জানাই। ব্যক্তিগতভাবে এমন কোনো রাষ্ট্রপ্রধান নাই, যার কাছে তিনি আপিল করেন নাই যে শেখ মুজিবকে ছেড়ে দাও। তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রের কাছে বলেছেন, তোমরা ইয়াহিয়া খানকে বলো শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেবার জন্য। একটা রাজনৈতিক সলিউশন করার জন্য। এক কোটি লোক মাতৃভূমি ত্যাগ করে অন্য দেশে চলে গেছে! এমন অনেক দ্যাশ আছে, যেখানে লোকসংখ্যা ১০ লাখ, ১৫ লাখ, ২০ লাখ, ৩০ লাখ, ৪০ লাখ, ৫০ লাখ। শতকরা ৬০টা রাষ্ট্র আছে, যার জনসংখ্যা এক কোটির কম।

আর আমার বাংলার থেকে এক কোটি লোক মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে ভারতে স্থান নিয়েছিল। কত লোক সেখানে অসুস্থ অবস্থায় মারা গেছে। কত না খেয়ে খেয়ে কষ্ট পেয়েছে। কত ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে এই পাষণ্ডের দল। ক্ষমা করো, আমার ভাইয়েরা ক্ষমা করো। আইজ আমার কারো বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা নাই। একটা মানুষকে তোমরা কিছু বোলো না। অন্যায় যে করে তাকে সাজা দেব। আইন-শৃঙ্খলা তোমাদের হাতে নিও না। মুক্তিবাহিনীর যুবকরা, তোমরা আমার সালাম গ্রহণ করো (জনতা সমস্বরে ‘জয় বাংলা’)। ছাত্রসমাজ, তোমরা আমার সালাম গ্রহণ করো (জনতা সমস্বরে ‘জয় বাংলা’)। শ্রমিকসমাজ, তোমরা আমার সালাম গ্রহণ করো (জনতা সমস্বরে ‘জয় বাংলা’), কৃষকসমাজ, তোমরা আমার সালাম গ্রহণ করো (জনতা সমস্বরে ‘জয় বাংলা’)। তোমরা গ্রামবাংলার হতভাগ্য হিন্দু-মুসলমান আমার সালাম গ্রহণ করো (জনতা সমস্বরে ‘জয় বাংলা’)। আর আমার যে কর্মচারীরা, যে পুলিশ, বিডিআর, ইপিআর, যাদের ওপরে মেশিনগান চালিয়ে দেয়া হয়েছে; যারা মা-বোন ত্যাগ করে পালিয়ে গিয়েছে, তার স্ত্রীদেরকে গ্রেফতার করে কুর্মিটোলা নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তোমাদের সকলকে আমি সালাম জানাই, তোমাদের সকলকে আমি শ্রদ্ধা জানাই।

নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা। বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে, এই আমার জীবনের সাধনা, এই আমার জীবনের কাম্য। আমি যেন এই কথা, এই চিন্তা করেই মরতে পারি। এই দোয়া, এই আশীর্বাদ আপনারা আমারে করবেন। এই কথা বলে আপনার কাছ থেকে বিদায় নেবার চাই। আমাদের সহকর্মীদের আমি সকলকে ধন্যবাদ জানাই, যারা আমার, যাদের আমি যে কথা বলে গেছেলাম, তারা সকলে যত এখানে আছে আমার, তারা একজন একজন করে তা প্রমাণ করে দিয়েছে যে না, মজিব ভাই বলে গেছে—তোমরা সংগ্রাম করো, তোমরা স্বাধীন করো, তোমরা জান দেও, বাংলার মানুষকে মুক্ত করো, আমার জন্য চিন্তা করো না, আমি চললাম, যদি ফিরে আসি, আমি জানি ফিরে আসতে পারব না, কিন্তু আল্লাহ আছে। তাই আইজ আমি আপনাদের কাছে ফিরে এসেছি। তোমাদের আমি, আমার সহকর্মীরা, তোমাদের আমি মোবারকবাদ জানাই। আমি জানি কী কষ্ট তোমরা করেছ। আমি কারাগারে বন্দি ছিলাম। নয় মাস পর্যন্ত আমাকে কাগজ দেয়া হয় নাই। একথা সত্য, যাবার—আসার সময় ভুট্টো সাহেব আমাকে বলেছিলেন, শেখ সাব চেষ্টা কইরেন দুই অংশের কোনো একটা বাঁধন রাখা যায় কিনা (জনগণের সমস্বরে হাসি, সেইম সেইম চিত্কার)। আমি বললাম, আমি কিছু বলতে পারি না, আমি কোথায় আছি জানি না। আমার বাংলা, আমার সে মাটিতে যাইয়া আমি বলব। আজ বলছি ভুট্টো সাহেব, সুখে থাকো, বাঁধন টুটে গেছে; আর না। তুমি যদি কোনো বিশেষ শক্তির সঙ্গে গোপন পরামর্শ করে আমার বাংলার স্বাধীনতা হরণ করতে চাও, এবার মনে রেখো, এবার দাঁড়াইয়া নেতৃত্ব দেবে শেখ মজিবুর রহমান, মরে যাবে, স্বাধীনতা আর হারাতে—ছাড় দেব না।

ভায়েরা আমার, আমার ৪ লক্ষ বাঙ্গালি আছে পশ্চিম পাকিস্তানে। আমি অনুরোধ করব, তবে একটা জিনিস আমি বলতে চাই, তোমাদের অ্যাপ্রুভাল নিয়ে আমার সহকর্মীরা, ইন্টারন্যাশনাল ফোরামে, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে, অথবা ওয়ার্ল্ড জুরিসডিকশনের পক্ষের থেকে একটা ইনকোয়ারি হতে হবে যে কী পাশবিক অত্যাচার, যেভাবে হত্যা করেছে আমাদের লোকদের, এ সত্য দুনিয়ার মানুষকে জানাতে হবে। আমি দাবি করব জাতিসংঘকে, ইমিডিয়েটলি বাংলাদেশকে আসন দাও এবং এই করুণ কাহিনী ইনকোয়ারি করো।

ভাইয়েরা আমার, যদি কেউ চেষ্টা করেন ভুল করবেন। আমি জানি ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই। সাবধান বাঙ্গালিরা, ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই। একদিন বলেছিলাম ঘরে ঘরে দুর্গ তৈয়ার করো, বলেছিলাম? (জনগণ সমস্বরে উত্তর দেয় ‘হ্যাঁ’) বলেছিলাম যার যা আছে তা-ই নিয়ে যুদ্ধ করো, বলেছিলাম? (জনগণ সমস্বরে উত্তর দেয় ‘হ্যাঁ’)  বলেছিলাম এ সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এই জাগায়। ৭ই মার্চ তারিখে। আজ বলে যাচ্ছি, তোমরা ঠিক থাকো, একতাবদ্ধ থাকো। কারো কথা শোনো না। ইনশাল্লাহ স্বাধীন যখন হয়েছি, স্বাধীন থাকব। একজন মানুষ এই বাংলাদেশে বেঁচে থাকতে পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে।

আইজ আমি আর বক্তৃতা করতে পারছি না। একটু সুস্থ হলে আবার বক্তৃতা করব। আপনারা আমারে মাফ করে দেন। আপনারা আমারে দোয়া কইরেন। আপনারা আমারে দোয়া করবেন। আপনারা আমার সাথে সকলে আজকে একটা মোনাজাত করেন, আল্লাহুম্মা আমিন।

(মোনাজাত)

জয় বাংলা, জয় বাংলা

জয় বাংলা, জয় বাংলা

জয় বাংলা, জয় বাংলা।

আসসালামু আলাইকুম।

(সবাই সমস্বরে) ‘জয় বঙ্গবন্ধু’।

(শিরোনামটি ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে প্রকাশিত দৈনিক বাংলা পত্রিকা থেকে নেয়া)

[১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখ জনতার সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ভাষণ]

সূত্র: বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি দলিল

Comments

comments

More Stories

১ min read
১ min read
১ min read

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!