এপ্রিল ১৮, ২০২৪ ১০:৫২ পূর্বাহ্ণ || ইউএসবাংলানিউজ২৪.কম

তিনি সৈয়দ শামসুল হক

১ min read

গল্প, কবিতা, উপন্যাস- সবখানেই সফল পদচারণা ছিলো সৈয়দ শামসুল হকের। তবে এর বাইরে তিনি একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবেও নন্দিত ছিলেন। তার লেখা ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নুরুলদিনের সারা জীবন’, ‘ঈর্ষা’সহ বিখ্যাত কয়েকটি মঞ্চনাটক আমাদের নাট্যাঙ্গনকে করেছে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ।

একজন আপাদমস্তক চলচ্চিত্রের মানুষ, গানেরও মানুষ ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। তার হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্র পেয়েছে ‘সুতারাং’, ‘মাটির ময়না’, ‘ময়নামতি’, ‘বড় ভাল লোক ছিল’, ‘তোমার আমার ঠিকানা’, ‘নতুন দিগন্ত’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘গেরিলা’র মতো বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র। এই ছবিগুলোর চিত্রনাট্য লিখেছিলেন সৈয়দ হক। সম্ভবত ১৯৬৪ সালে মুক্তি পাওয়া সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘সুতারাং’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখার মধ্য দিয়েই চিত্রনাট্যকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি।

তার শেষ চিত্রনাট্য ছিলো ২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ী চলচ্চিত্র ‘গেরিলা’। তারই উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে ছবিটির চিত্রনাট্য করেছিলেন তিনি। এটি পরিচালনা করেছিলেন নাট্যজন নাসিরউদ্দিন ইউসূফ বাচ্চু।

ছবিটি দিয়েই নিজেকে তিনি আরো এক পরিচয়ে সমৃদ্ধ করে তুলেন। সেটি হলো গীতিকবি সৈয়দ হক। ‘সুতারাং’ ছবিতে তার বেশ কিছু গান জনপ্রিয়তা পায়। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য, ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’, ‘তুমি আসবে বলে, কাছে ডাকবে বলে, ভালোবাসবে বলে শুধু মোরে’ গান দুটো। এই দুটি গান নিয়ে জীবনের শেষ বয়সে দারুণ এক মজার স্মৃতি নিয়ে গেলেন লেখক।

লন্ডন থেকে ফিরে এসে কবি সৈয়দ শামসুল হক নিকেতনে নিজ বাড়িতে স্বজনদের সঙ্গেই ছিলেন। পরে ভর্তি হয়েছিলেন ইউনাইটেড হাসপাতালে। ডাক্তারদের নিষেধ বাইরের কেউ যাতে কবির সঙ্গে দেখা না করে।  কিছুদিন এ নিয়ম মানা হয়। কিন্তু কবিকে কতদিন নিয়মে আগলে রাখা যায়।

লেখক আনিসুল হককে কবি পত্নী সৈয়দা আনোয়ারা হক বলেছেন, প্রটোকল ভেঙে গেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে এসে প্রটোকল ভেঙে দিয়ে গেছেন। এখন প্রতিদিনই কবিকে দেখতে তার ভক্ত শুভানুধ্যায়ীরা হাসপাতালে যাচ্ছেন। কবিও উপভোগ করছেন শুভানুধ্যায়ীদের সান্নিধ্য। তখন হাসপাতালটির ছয় তলার কেবিনে কবিকে দেখতে গিয়েছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। গেল ১৭ সেপ্টেম্বর তাকে দেখতে গিয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মিষ্টি  মেয়ে’ নায়িকা কবরী। নায়িকাকে দেখেই গান গেয়ে উঠেছিলেন কবি ও লেখক সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক। ‘সুতরাং’ ছবির ‘পরানে  দোলা দিল এ কোন  ভোমরা’  গেয়ে কবরীকে স্বাগত জানান সৈয়দ হক। কবরীও গেয়ে ওঠেন একই সিনেমার ‘তুমি আসবে বলে/ কাছে ডাকবে বলে’ গানটি। গানে গানে প্রাণবন্ত কিছু সময় কাটালেন ‘সুতারাং’ দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষেক হওয়া নায়িকা ও চিত্রনাট্যকার-গীতিকার।

এছাড়াও বেশ কিছু কালজয়ী এবং জনপ্রিয় গান লিখে গেছেন কবি। তারমধ্যে চিরকাল সৈয়দ হককে মানুষের হৃদয়ে অমর করে রাখবে ‘বড় ভালো লোক ছিলো’ ছবির ‘হায়রে মানুষ রঙ্গীন ফানুস’ গানটি। মানবজীবনের অবধারিত পরিণতি নিয়ে লেখা এই গানটি এমন কোনো মানুষ নেই যার হৃদয়কে দোলা দেয় না। সৈয়দ হকের কথায় অবিস্মরণীয় এই গানটির সুর করেছিলেন আলম খান এবং গেয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর।

একসময় মানুষের মুখে মুখে ছিলো ‘এমন মজা হয় না, গায়ে সোনার গয়না, বুবু মনির বিয়ে হবে বাজবে কত বাজনা।’ দর্শক শ্রোতাদের হৃদয়ে গেঁথে থাকা আরো অনেক গানের মধ্যে আছে ‘একই অঙ্গে এত রূপ’ চলচ্চিত্রের ‘জানিনা সে হৃদয়ে কখন এসেছে/ প্রাণের মাঝে দোলা দিয়েছে’, ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ ছবিতে ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠে ‘যার ছায়া পড়েছে, মনেরও আয়নাতে’, ‘ময়নামতি’ ছবির ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়’, ‘আশীর্বাদ’ চলচ্চিত্রের ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা’।

আরো বেশ কিছু গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘নদী বাঁকা জানি, চাঁদ বাঁকা জানি’, ‘তোরা দেখ দেখ দেখরে চাইয়া, রাস্তা দিয়া হাইটা চলে রাস্তা হারাইয়া’, ‘আমি চক্ষু দিয়া দেখতাছিলাম জগৎ রঙ্গিলা’, ‘চাম্বেলিরও তেল দিয়া কেশ বান্ধিয়া’, ‘পাগল পাগল মানুষগুলো পাগল সারা দুনিয়া, কেহ পাগল রূপ দেখিয়া, কেহ পাগল শুনিয়া’ ইত্যাদি।

গান নিয়ে এক সাক্ষাতকারে সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন, তিনি কখনো গান লিখতে চাননি! তাকে প্রথম গান লিখতে হয়েছিল প্রডাকশনের খরচ বাঁচাতে এবং সুরকার সত্য সাহাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য।  জীবনের প্রথম গান লিখেছিলেন, ফরাশগঞ্জে একটি বাড়ির চিলেকোঠায় বসে ১৯৬৩ সালে। এটি ছিলো ‘সুতরাং ছবির ‘তুমি আসবে বলে, কাছে ডাকবে বলে, ভালোবাসবে বলে শুধু মোরে’। এর সুর করেছিলেন সত্য সাহা।

আরো একটি মজার বিষয় হলো সৈয়দ হক নিজের নাম লিখিয়ে গেছেন একজন চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও। তিনি ১৯৬৬ সালে পরিচালনা করেছিলেন উর্দু সিনেমা ‘ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো’। এখানে অভিনয় করেছিলেন নাজনীন, গোলাম মুস্তাফা, আনোয়ারা, সুভাষ দত্ত, রেশমা, ফতেহ লোহানী, হারুন রশীদ প্রমূখ। এটি ১৯৬৬ সালের ১০ জুন মুক্তি পায়।

সৈয়দ শামসুল হকের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে চলচ্চিত্র পাড়ায়। শিল্পী সমিতি, চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতি, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, সিডাব, বাচসাসসহ বিভিন্ন সংগঠন তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছে।

নায়করাজ রাজ্জাক, ফারুক, সোহেল রানা, কবরী, ববিতা, ইলিয়াস কাঞ্চনসহ চলচ্চিত্রের অনেকেই প্রকাশ করেছেন গভীর শোক।

Comments

comments

More Stories

১ min read
১ min read
১ min read

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!